কর্ণাটকের উত্তর কন্নড় জেলার হোনালি গ্রাম আজও তাকে মনে করে। ঘন অরণ্যের ফাঁকে ফাঁকে দাঁড়িয়ে থাকা অসংখ্য গাছ যেন নীরবে জানান দেয়—এই সবুজের পেছনে ছিলেন এক নারী, যার নাম তুলসী গৌড়া। তিনি আর নেই, কিন্তু তার কর্ম ও স্মৃতি আজও মানুষের হৃদয়ে অম্লান।
সাদাসিধে শাড়ি পরা, খালি পায়ে চলাফেরা করা এই আদিবাসী নারীকে দেখে কেউ ভাবতেই পারেননি, তিনি একদিন হয়ে উঠবেন ভারতের পরিবেশ আন্দোলনের এক জীবন্ত প্রতীক। মাত্র দুই বছর বয়সে বাবাকে হারানো তুলসী গৌড়া দারিদ্র্যের কারণে কোনোদিন স্কুলে যেতে পারেননি। বইয়ের অক্ষর ছিল তার অজানা, কিন্তু প্রকৃতির ভাষা ছিল তার নিত্যসঙ্গী।
শৈশব থেকেই মায়ের সঙ্গে জঙ্গলে যাওয়া-আসার মধ্য দিয়েই গড়ে ওঠে তার জ্ঞানভান্ডার। কোন গাছের বীজ কখন সংগ্রহ করতে হয়, কোন ঋতুতে কোন চারা লাগালে তা টিকে থাকবে—এসব তিনি শিখেছিলেন প্রকৃতির কাছ থেকেই। সেই জঙ্গলই হয়ে ওঠে তার স্কুল, কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয়।
দীর্ঘ ৩৫ বছর কর্ণাটক বন বিভাগের নার্সারিতে দৈনিক মজুরির শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন তুলসী গৌড়া। বীজ সংগ্রহ ও চারাগাছ পরিচর্যায় তার দক্ষতায় মুগ্ধ হন বন বিভাগের কর্মকর্তারাও। পরে তার অভিজ্ঞতার স্বীকৃতি হিসেবে তাকে স্থায়ীভাবে বন বিভাগে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সেখানে টানা ১৫ বছর দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
তার হাত ধরে রোপিত হয়েছে ৩০ হাজারেরও বেশি গাছ। হোনালি গ্রাম ও আশপাশের এলাকাজুড়ে আজ যে সবুজের সমারোহ, তার বড় অংশই এই এক নারীর অবদান। পরিবেশবিদদের কাছে তিনি পরিচিত ছিলেন ‘এনসাইক্লোপিডিয়া অফ ফরেস্ট’ নামে—কারণ বনের প্রতিটি ‘মাদার ট্রি’ বা মা গাছ তিনি নির্ভুলভাবে চিনতে পারতেন।
পরিবেশ সংরক্ষণে অনন্য অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ২০২০ সালে ভারত সরকার তাকে পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত করে। রাষ্ট্রপতি ভবনে খালি পায়ে পদক গ্রহণের দৃশ্য সারা দেশে আবেগের জন্ম দেয়। সেদিন রাষ্ট্রের শীর্ষ নেতৃত্বও শ্রদ্ধায় মাথা নত করেন।
পুরস্কার পাওয়ার পর তুলসী গৌড়া বলেছিলেন, সম্মানের চেয়ে তার কাছে জঙ্গল আর গাছপালাই বেশি প্রিয়। এই কথাতেই ধরা পড়ে তার জীবনদর্শন।
২০২৪ সালের ১৬ ডিসেম্বর ৮৬ বছর বয়সে তিনি পৃথিবী থেকে বিদায় নেন। তবে তিনি রেখে গেছেন এক জীবন্ত উত্তরাধিকার—সবুজ বন, সচেতন মানুষ আর প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসার এক অনন্য শিক্ষা।
তুলসী গৌড়া প্রমাণ করে গেছেন, মানুষকে মহান করে তোলে ডিগ্রি নয়, বরং শ্রম, নিষ্ঠা আর ভালোবাসা। আজও তার লাগানো প্রতিটি গাছ তাকে নীরবে স্মরণ করে, আর তার জীবন নতুন প্রজন্মের পরিবেশকর্মীদের অনুপ্রেরণা হয়ে বেঁচে আছে।
মন্তব্য করুন